ঢাকা শহর শুধু বাংলাদেশের রাজধানীই নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এই মহানগরীর অন্যতম ভয়াবহ সংকট আজ ট্রাফিক জট। প্রতিদিন হাজারো মানুষ মূল্যবান সময় হারাচ্ছেন এই যানজটে, যার ফলে ব্যক্তি জীবন, অর্থনীতি এবং পরিবেশ- সবকিছুই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। শহরের মোট সড়কপরিমাণ আয়তনের মাত্র ৭–৮ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এই হার হওয়া উচিত অন্তত ২৫ শতাংশ। ফলে সড়ক সংকুচিত, কিন্তু যানবাহনের চাপ বিপুল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ফুটপাত দখল, অপ্রশিক্ষিত চালক, ট্রাফিক আইন না মানা ও গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা।
এই ট্রাফিক জট কেবল নাগরিকদের সময় নষ্ট করছে না, এর ফলে দৈনিক লাখ লাখ লিটার জ্বালানি অপচয় হচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ মারাত্মকভাবে বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। সেই সঙ্গে মানসিক চাপ, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং নাগরিক জীবনের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। কর্মজীবী মানুষ প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে ক্লান্ত ও অকার্যকর হয়ে পড়ছেন, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় উৎপাদনশীলতায়।
এই সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বেশিরভাগই ছিল খণ্ডিত, অদূরদর্শী এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (BRT), ফ্লাইওভার বা আন্ডারপাস- এসব উদ্যোগ স্বাগতযোগ্য হলেও এগুলোর সমন্বয় ও বাস্তবায়নে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। রিকশা, বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যানবাহন একই রাস্তায় চলায় বিশৃঙ্খলা আরও বাড়ছে। পাশাপাশি, ট্রাফিক পুলিশ বাহিনীর সংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, এবং ট্রাফিক আইন প্রয়োগে দুর্বলতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সমাধান এক দিনে সম্ভব নয়, তবে একটি সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিক, নিরাপদ ও সহজলভ্য করতে হবে যেন মানুষ প্রাইভেট গাড়ির উপর নির্ভরশীল না হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার- যেমন স্মার্ট সিগনাল, GPS মনিটরিং, এবং ডিজিটাল জরিমানা- বাড়াতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স ব্যবস্থাকে কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো, নগর পরিকল্পনায় পথচারী ও সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয় জোরদার করা।
ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা কোনো ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি সামষ্টিক দুর্যোগ। এ সমস্যা সমাধানে সরকার, সিটি করপোরেশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
এই শহর যেন শুধু ভোগান্তির প্রতীক না হয়ে ওঠে, বরং একটি সচল, বাসযোগ্য, মানবিক নগরীতে পরিণত হোক- এটাই প্রত্যাশা।